নিজস্ব প্রতিনিধি, দৈনিক জামালপুর বার্তা: জামালপুরের মাদারগঞ্জের তৃতীয় বারের মতো ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছে।
মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠেছে আশপাশের এলাকার মানুষ। এবার মেলার প্রধান আকর্ষণ হরেক রকমের মিষ্টান্ন, নানা প্রজাতির বড় বড় মাছ, ঘোড়দৌড় এবং কাঠের আসবাবপত্র। উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের পলাশপুর কালার মোড় নামক স্থানে বিশাল ফসলের মাঠজুড়ে বসেছে এ মেলা।
গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে আগামী ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, মেলাকে ঘিরে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নারী, পুরুষ, বয়োবৃদ্ধ, শিশু-কিশোরসহ হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে মেলার আশপাশের এলাকা। মেলায় বালিশ মিষ্টি, মাছ মিষ্টি, রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ, হাসিখুশি মিষ্টি, খাজা, জিলাপিসহ নানা ধরনের রকমারি মিষ্টির পসরা বসেছে।
রয়েছে বিভিন্ন রকমের কসমেটিকের দোকান। সেখানে নানা বয়সীসহ তরুণীরা ভীড় করছেন তাদের পছন্দের কসমেটিক সামগ্রী ক্রয় করতে।
এবারের মেলায় হরেকরকম পণ্যের পাশাপাশি ঘোড়দৌড়, মইদৌড়, লাঠিখেলা ছাড়াও শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলা, চরকি, দোলনাসহ নানা আয়োজন। এ মেলায় নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছসহ চিতল, কোরাল, বোয়াল, আইড়, কালবাউশ, রুই-কাতলা, রুপচাঁদা, গুলসা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। সেসব মাছের ওজন ৫ থেকে ২০ কেজি বা তারও বেশি।
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুড়ে দেখা যায়, মেলায় সার্কাস, মোটর রেস, জাদুসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্নারে সব বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। বড়দের হাত ধরে এসেছে শিশুরাও। তাদের যেন আনন্দের সীমা নেই।
আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে মাদারগঞ্জে ঐতিহ্য হিসেবে শুরু হয় এই জামাই মেলা। এরপর থেকে প্রতিবছরই এ মেলার আয়োজন করছেন মেলা উদযাপন কমিটি। এবারের মেলায় কসমেটিকস, প্রসাধনী, খাবার, খেলনা, মিঠাই-মিষ্টান্ন, মাছ, মাংস ও আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক দোকান বসেছে।
অস্থায়ী দোকান রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক। মেলায় আছে বিভিন্ন ধরনের আচার, চটপটি-ফুচকা থেকে শুরু করে মুখরোচক নানা পদের খাবারের দোকানও। প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবমুখর হয়ে উঠে পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। গলায় মালা ও শাড়ি পরে মেয়ে-জামাই মেলায় এসে আনন্দ উপভোগ করেছেন। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ও আশপাশের জেলা থেকে দর্শনার্থীরা মেলায় যোগ দিয়েছেন।
মেলায় কথা হয় মোস্তাফিজুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম, ইব্রাহিম খলিল, নাহিদুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীসহ বেশকয়েকজন দর্শনার্থীদের সাথে। তারা জানান, বিগত বছরের তুলনায় এবারের মেলা বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। এ মেলায় গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ স্টল রয়েছে। আয়োজন যেহেতু বড়, সেহেতু দর্শনার্থীদের উপস্থিতিও বেশি। মেলায় এসে তারা খুবই আনন্দিত।
স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুর রহমান সাকিল জানান, মেলাকে ঘিরে চরপাকেরদহ, চরনগর, ফাজিপুরসহ আশপাশের এলাকার বিবাহিত মেয়েরা তাদের স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়িরা বেশ আগে থেকেই নেন নানা প্রস্তুতি। মেলার দিন জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন শশুর-শাশুড়িরা। আর সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে জামাইয়েরা মেলা থেকে মিষ্টি, জিলাপি, মাছ, পান-সুপারিসহ বিভিন্ন জিনিস কিনেন।
চরপাকেরদহ এলাকার জামাই সোজা মিয়া বলেন, মেলার আগেই দিন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে শশুরবাড়িতে এসেছি। শাশুড়ি মা মেলার দিন কিছু টাকা দিয়েছেন মেলা করার জন্য। মেলায় এসে খুব ভালো লেগেছে।
মেলায় আব্দুল বারী নামের এক প্রবীণ জানান, এই মেলা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে তাদের এলাকায় দারুণ একটা প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তিনি অন্যান্য বারের মতো মেলা উপলক্ষে তার জামাতাকে এবারও দাওয়াত করেছিলেন। মেয়ে ও জামাতা মেলার আগের দিন চলে এসেছেন বলে জানান তিনি।
সোলাইমান কবির নামের এক মিষ্টি ব্যবসায়ী জানান, এই মেলায় সবচেয়ে বেশি মিষ্টি বিক্রি হয়। কারণ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এ মেলা থেকে মিষ্টি নিয়ে জামাইদের আপ্যায়ন করেন। আবার জামাইরাও শ্বশুরবাড়ির জন্য মিষ্টি নিয়ে যান। তিনি আশা করছেন, গতবারের তুলনায় এবার মেলায় বেশি কেনা-বেচা হবে তাদের।
মাছ ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, মেলায় ১৫-২০ কেজি ওজনের রুই-কাতলা এনেছি। ভালো বিক্রি হচ্ছে। এবারের মেলায় মানুষের উপস্থিতি অনেক বেশি।
মেলা উদযাপন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান সমন্বয়ক মোখলেছুর রহমান মোখলেস বলেন, ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় জামাই মেলা জমে উঠেছে। মেলায় নারী-পুরুষ ও শিশুদের ঢল নেমেছে। সাতদিন ব্যাপী এ মেলায় ৩২০ টি স্টল রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য পুরো মেলা ঘিরে ১৫০জন সদস্য শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করছেন।
পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও রয়েছেন এছাড়াও পুরো মেলা সিসি ক্যামেরায় আওতায় আনা হয়েছে, এ মেলায় গাড়ি পাকিং এর ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
মেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি খালেদ মাসুদ তালুকদার সোহেল বলেন, মেলায় গতবারের চেয়ে এবার আরও বেশি মানুষের সমাগম ঘটছে। এ মেলায় প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে নানা বয়সের মানুষ এ মেলায় আসছেন এবং নিজের পছন্দমতো মাছসহ বিভিন্ন পণ্য কিনছেন। মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।