নিজস্ব প্রতিনিধি,দৈনিক জামালপুর বার্তা:
দেশ বিদেশে মির্জা আজমের সম্পদের পাহাড় রয়েছে বলে জানাগেছে।
মির্জা আজম সরকারি টাকায় সরকারি জমিতে জামালপুর মির্জা আজম অডিটোরিয়াম, মেলান্দহ ও মাদারগঞ্জ উপজেলা অডিটোরিয়ামসহ নিজ নামে করেছেন অর্ধশতাধিক নানা প্রতিষ্ঠান।
মির্জা আজমের আর একটি পরিচয় হলো তিনি অবৈধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জিএমবির) প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের শ্যালক। জামালপুরের রাজনীতিতে একটি সেøাগানও প্রচলিত আছে। শায়খ রহমান-বাংলা ভাই, মির্জা আজমের দুলাভাই।
মির্জা আজম কেবল জামালপুরের প্রভাবশালী নেতা নয়, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী।
মির্জা আজমের বাবা ছিলেন মির্জা আবুল কাশেম। লোকমুখে শোনা যায়, তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজমের একনিষ্ঠ ভক্ত। এলাকার মানুষ তাকে রাজাকার হিসাবে চিনতেন কিন্তু কেউ মির্জা আজমের ভয়ে মুখ ফসকে কখনো বলতে সাহস পেতেন না।
তাই তিনি তার ছেলেদের নামের সাথে যুক্ত করে দিয়েছিলেন গোলাম। যেমন মির্জা গোলাম আজম, মির্জা গোলাম কবির, মির্জা গোলাম শিপন ও মির্জা গোলাম রিপন। অন্য ভাইদের নামের সাথে গোলাম শব্দ থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের আলোচিত হওয়ার জন্য বাবা-মায়ের রাখা নাম থেকে এফিডেভিট করে গোলাম শব্দটি বাদ দিয়ে হন মির্জা আজম।
এরপর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনার। আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদও পান। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গাতেই মির্জা আজমের ছিল ব্যাপক প্রভাব।
নিজ জেলা জামালপুরে ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। তার ইশারায় চলতো জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। আর ক্ষমতার এই মহাদাপটে মির্জা আজম নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড়।
রাজধানী ঢাকা, জামালপুর এবং নির্বাচনী এলাকা মেলান্দহ-মাদারগঞ্জসহ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার অঢেল সম্পদ। মির্জা আজম জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) নির্বাচনী আসনে নানা ভাবে ভোট জালিয়াতি ও প্রশাসন দিয়ে ভোট কারচুপির মাধ্যমে ৮ বার সংসদ সদস্য হন।
দায়িত্ব পান জাতীয় সংসদের হুইপ ও বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রীর। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, যা তার বৈধ আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় ।
অবৈধ ভাবে গড়ে তুলেছেন
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা শাখার অনুসন্ধানে আজমের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।
তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ লুটপাট করে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে শতশত কোটি টাকার সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে।
সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম দেশের যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই করেছেন সম্পদ। প্রতিষ্ঠা করেছেন স্ত্রী-সন্তান-ভাইদের নামে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নিজ ও স্ত্রী, ভাই-ভাইবৌ ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের নামে করেছেন স্থাবর সম্পত্তি, ফ্ল্যাট, বাগানবাড়িসহ জমি ক্রয় ।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের কয়েকদিন আগে থেকে পর গা-ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই নেতা। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মির্জা আজমের নামে-বেনামে যত সম্পদ : ঢাকার ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোডে (পুরনো ২৮ নম্বর) ক্ষমতা অপব্যবহার ও প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্লট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন একই রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে।
১৯৯৬ সালে এমপি থাকাকালে ঢাকার নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকায় পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে প্লট পরিবর্তন করে বারিধারায় ১০ নম্বর সড়কে নতুন প্লট বরাদ্দ নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন।
শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছর কনস্ট্রাকশন সেকশনে আলোচিত তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার হলেন আজম। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা সহ জামালপুরে বড় বড় প্রকল্পগুলো করে যাচ্ছেন।
এ ছাড়া অপি হাউজিং কোম্পানির মালিকও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই নেতা। জনৈক আবু সালেহ গেন্দার নামে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন খাতে তিনি করেছেন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ।
জামালপুর শহরে পৌরসভা ভবনের পাশে আছে স্ত্রী আলেয়া আজমের নামে বিলাসবহুল বাড়ি আলেয়া কটেজ। গত ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তাতে ভাঙচুর চালায়। জামালপুর শহরে সুরপাড়া দেউরপাড় চন্দ্রায় অবৈধ ভাবে দখল নিয়ে ১০ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন আলেয়া গার্ডেন নামে একটি রিসোর্ট সেন্টার।
মেলান্দহ উপজেলার দুরমুট ইউনিয়নে তমা কংক্রিট লিমিটেডে তার রয়েছে বড় অঙ্কের শেয়ার। যে কারখানায় রেলের পার তৈরি করে এককভাবে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা।
মেলান্দহর নয়ানগর ইউনিয়নের কান্দাপাড়ার বাসিন্দা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা (বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক) মিনহাজের নামে জামালপুর শহর এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে মির্জা আজম কিনেছেন প্রায় ৩০০ একর জমি ।
পৌর শহরের চর নাওভাঙ্গা মৌজায় জোড় জবস্তি এবং খাস-খতিয়ান দেখিয়ে দখলে নিয়েছে অনেক জমি।
এ ছাড়া জামালপুর শহরের বকুলতলা মোড়ে ৮ শতাংশ জমির ওপর তার বিলাসবহুল বাড়ি, মেডিক্যাল রোডে তিনতলার দু’টি বাড়ি বজ্রাপুর এলাকায় মির্জা রাইস মিল, যেটি পরিচালনা করেন তার ছোট ভাই মির্জা গোলাম কবির।
মাদারগঞ্জ পৌর শহরের বালিজুড়ি বাজারে দুই একর জমিতে রয়েছে নুরুন্নাহার মার্কেট ও বকুল মার্কেট নামে দু’টি মার্কেট, মাদারগঞ্জ উপজেলা চত্বরে এক একর জমিতে আরো দু’টি মার্কেট, উপজেলা সংলগ্ন ২ একর জমি, মেলান্দহ উপজেলার পৌর শহরের বকুলতলার পাশে ৩০ শতাংশ জমি (সাবেক কোয়েলী সিনেমা হল)। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তার নামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ।
ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি ডেইরি কোম্পানির মালিকানা রয়েছে মির্জা আজমের। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে রয়েছে স্ত্রী আলেয়া আজমের মালিকানাধীন নালিতাবাড়ী ফিশারিজ।
কক্সবাজারে পাঁচতলা সিগাল হোটেলের অন্যতম শেয়ারার মির্জা আজম। ওই হোটেলের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী আলেয়া আজম বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নেত্রকোনায় শ্বশুর বাড়িতে স্ত্রীর নামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেয়া মির্জা আজমের হলফনামায় মোট সম্পদের হিসাব দেখানো হয়েছে ৬৫ কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, যা বর্তমানে হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
তার আলাদিনের চেরাগের অন্যতম দ্বৈত্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপ। এই তমা গ্রুপের অংশীদার হিসেবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সরকারের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে এই তমা কনস্ট্রাকশনের নামে ।